বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে, বনে-বাদড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গাছ-পালা, লতা-পাতা। একেক গাছের রয়েছে একেক গুণাবলী। অধিকাংশ ওষুধই তৈরি হয়, কোনো কোনো গাছের মলিকিউল দিয়ে। আর এই পদ্ধতি আদিম যুগ থেকে চলে এসেছে। মানুষ হাত কাঁটলে কিছু লতা-পাতা থেঁতো করে তাৎক্ষণিক রক্ত বন্ধ করতো; হাঁড় ভাঙলে, জ্বর আসলে নিজেদের আশেপাশের গাছ-পালাকেই কাজে লাগাতো। অথচ, বাংলাদেশের তিনভাগের এক ভাগ গাছ নিয়েও কাজ হয়নি। কিন্তু, বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের প্রচুর ঔষধি গাছের তথ্য সংগ্রহ হয়েছে। নিম, থানকুনি, সজনে, হরিতকি, বহেরা, ইত্যাদি বহু প্রচলিত ঔষধি গাছগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। তবে, টেকভার্সের আজকের এই আর্টিকেলে, আমরা আমাদের আশে-পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা— .‘জাদুকরী ৫টি ঔষধি গাছ’ সম্পর্কে আলোচনা করব; যেগুলি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। চলুন শুরু করা যাক—
জাদুকরী ৫টি ঔষধি গাছ
ভাঁটফুল বা বনজুঁই:
গ্রামের রাস্তায় হেঁটে গেলে একটা মনোমুগ্ধকর সাদা ফুল সবারই চোখে পড়ে। অনেক কবি বা শিল্পীর কবিতা গানে ভাঁটফুলের চমৎকার সৌন্দর্য ওঠে এসেছে। আর এই সুন্দর ফুল গাছটির কেবল সৌন্দর্য নয়, রয়েছে বেশ ঔষধি গুণ। গ্রামে আদিকাল থেকে এই ভাঁটফুল গাছের পাতা ব্যবহার হয়ে এসেছে।
একেক এলাকায় এর একেক নাম প্রচলিত। ভাঁটফুল বা বনজুঁইয়ের প্রচলিত কিছু নাম হলো— ভাঁট, ভাইট, ঘেটু, ইত্যাদি। ভাঁটফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ক্লেরনডেনড্রন ভিসকোসাম (Clerondendron viscosum)। এটি একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই ভাঁটফুল মূলত Lamiales বর্গের Lamiaceae পরিবারের একটু বুনো উদ্ভিদ। এছাড়াও এর আদি নিবাস ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ ও মায়ানমার।
![ভাঁটফুল](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/1080px-Clerodendrum_viscosum_-_ভাট_ফুল_-_বনজুঁই_Bn-medium.jpg?resize=400%2C266&ssl=1)
ভাঁটফুল গাছ সাধারণত দণ্ডায়মান আকৃতির এবং এর পাতা খানিকটা পানপাতার মতো ও খসখসে। আর এর ফুল হয় সাদা রংয়ের, তবে এতে বেগুনী রংয়ের চমৎকার মিশেলও দেখা যায়। আর এই ফুলের সুগন্ধি ঘ্রাণ রয়েছে। এই ফুলের মধু মৌমাছিরা সবারহ করে থাকে।
⏩ আরও পড়ুন: পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা কী?
ভাঁটফুল গাছের পাতাকেই মূলত ঔষধি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পাতা থেঁতো করে রস খেলে তাৎক্ষণিক জ্বর হতে উপশম মেলে। এছাড়াও এই রস কৃমি, চুলকানি, কোলেস্টেরল, ব্লাড সুগার ও উদরাময়সহ নানা রোগ নিরাময়ে বেশ সহায়ক। বলা হয়ে থাকে, এই পাতার রসে প্রচুর ফ্ল্যাভোনয়েড আছে, যা ক্যান্সার রোগেও বেশ ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। যদিও তা এখনো বিস্তর গবেষণার বিষয়।
বিকাশ লতা বা রিফুজি লতা বা আসামি লতা:
বাংলার সর্বত্র যে লতাটি চোখে পড়ে, তা হলো— রিফুজি লতা বা আসামি লতা। যদিও এটি একেক অঞ্চলে একেক নামে পরিচিত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হলো— লাইড্ডালতা (বরিশাল), ওয়াবিপাতা (চট্টগ্রাম), কইয়ালতা, তরুলতা, বুচিলতা, রিফিউজি লতা, শঙ্খুনি লতা, ইত্যাদি। এই বিকাশ লতার বৈজ্ঞানিক নাম— মিকানিয়া মিক্রান্থা (Mikania micrantha)। যদিও এটির আরেকটি প্রজাতি রয়েছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম— Mikania scandens। এই লতা গাছটি অল্প সময়ে প্রচুর বৃদ্ধি পায়। এইজন্য একে ইংরেজিতে বলা হয় ‘মাইল অ্যা মিনিট’। এটি মূলত Asterales বর্গের Asteraceae পরিবারের উদ্ভিদ।
![জাদুকরী ৫টি ঔষধি গাছ!](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/540px-Mikania_micrantha_at_Kadavoor.jpg?resize=300%2C400&ssl=1)
![জাদুকরী ৫টি ঔষধি গাছ!](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/540px-Mikania_micrantha_at_Kadavoor.jpg?resize=300%2C400&ssl=1)
এই গাছের পাতা মাঝারি আকৃতির, আর এর ফুল হয় ছোটো ছোটো সাদা রংয়ের। এই গাছের পাতা থেকে একটা সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। যদি কারও হাত কেটে যায়, তাৎক্ষণিক এই পাতা থেঁতো করে লাগালে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। এছাড়াও দাদ, বিষাক্ত পোকা মাকড়ের কামড়, অ্যাকজেমা, বসন্ত, হাম, চুলকানিতে এই পাতা পিষে রস লাগালে উপশম পাওয়া যায়। আর এই আসামি লতার রস নিয়মিত খেলে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। আবার, এর রস খেলে গ্যাস্ট্রিক, পেটের সমস্যা ও পাকস্থলীর প্রদাহ কমায়। এছাড়াও এই পাতার রস মেছতা, শরীরের অনাকাঙ্খিত দাগ দূর করতেও সহায়ক।
অশ্বগন্ধা:
ছোটোবেলায় মাথায় অনেকেই এক ধরনের ফল দিয়ে ফোটকা ফুটিয়ে থাকবে। কিছুটা বোম্বাই মরিচের মতো খোসাটা, ভেতর ছোটো ফল, যেটি দেখতে মটরের মতো। এই গাছের প্রমিত নাম অশ্বগন্ধা হলেও, একে একেক অঞ্চলে একেক নামে থাকে, যেমন: ফটকা গাছ, বনমরিচ গাছ, বলদা, বাজিকরি, শীতকালীন চেরি, ইত্যাদি। এই গাছের গন্ধ কিছুটা ঘোড়ার মুত্রের মতো, তাই বাঙালিরা একে অশ্বগন্ধা নামেই চিনে। এর বৈজ্ঞানিক নাম— উইথানিয়া সোমনিফেরা (এল) ডুনাল বা Withania somnifera (L.) Dunal। এটি মূলত Solanales বর্গের Solanaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
![অশ্বগন্ধা](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/480px-WithaniaFruit.jpg?resize=273%2C410&ssl=1)
![অশ্বগন্ধা](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/480px-WithaniaFruit.jpg?resize=273%2C410&ssl=1)
এই গাছের ফুল, ফল, পাতা, ছাল, ডাল প্রায় সবই ঔষধি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই এর উপকারিতাও অনেক, যেমন:
- এই গাছকে বলা হয় শক্তিবর্ধক গাছ। কারণ এর রস খেলে শক্তি বাড়ে।
যাদের ঘুমের সমস্যা, তারা অশ্বগন্ধা গাছের গুঁড়ো খেলে ঘুমের সমস্যা হতে রেহাই পাবে।
অশ্বগন্ধার ফল খেলে পেট ফাঁপা, অম্বল, পেটে ব্যথাসহ পেটের নানা সমস্যা দূর হয়।
অশ্বগন্ধার মূল শুষ্ক কাশির উপশম করে।
এছাড়াও এটি আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌনশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম ওষুধ হিসাবে বহুকাল ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
⏩ আরও পড়ুন: গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় কেন খেজুর খাবেন?
যদিও এই অশ্বগন্ধা গাছটি বাংলার আনাচে-কানাচে দেখতে পাওয়া যায়। তবে, এর চাহিদা বাড়ায় অনেকেই একে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছে। ভারতে এটি বেশি চাষ করা হয় এবং এইজন্যই একে ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান জিনসেং বলে।
ভূঙ্গরাজ বা কালোকেশী:
বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা মেলে ভূঙ্গরাজ বা কালোকেশী গাছের। এটি বন-জঙ্গলে পুকুরের পাশে বেশি জন্মে। একে— কেশড়ে, কালোকশী, কেশরাজ, কেশঠি, কোশুতি, খেতুয়া, মইরচর, কালাহুনা, ইত্যাদি নামেও ডাকে হয় এবং এর ইংরেজি নাম False daisy। এছাড়াও এই কালোকেশীর বৈজ্ঞানিক নাম— ইক্লিপটা প্রোস্ট্রাটা বা (Eclipta prostrata)।
![কালোকেশী](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/1214px-False_daisy_or_bhringraj_Eclipta_prostrata_flower.jpg?resize=417%2C247&ssl=1)
![কালোকেশী](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/1214px-False_daisy_or_bhringraj_Eclipta_prostrata_flower.jpg?resize=417%2C247&ssl=1)
কালোকেশী গাছের পাতা খুবই ছোটো এবং এই ছোটো পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে সাদা ফুলের। আর এই ফুল থেকে ফল হয় গাঢ় সবুজ রংয়ের।
কেশরাজ বা কালোকেশী গাছের রয়েছে নানাবিধ ঔষধি গুণ। যেমন:
- এই গাছের পাতা, ফুল ও ফলসহ পিষে রস বানিয়ে মাথায় দিলে মাথা দিলে মাথা ঠাণ্ডা হয় এবং চুলপড়া কমে। তাই তো, বিভিন্ন ধরনের প্যাক, তেলে জায়গা হয় কালোকেশীর।
কেবল চুলপড়া রোধই করে না। এই কেশরাজ গাছের রস সপ্তাহে দুইদিন লাগালে উকুনমুক্ত হবে চুল।
এটির রস খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রতি, বেশ কিছু গবেষণায় ওঠে এসেছে, এই কালোকেশী গাছ ক্যান্সার কোষগুলোকে মেরে ফেলতে সক্ষম। এছাড়াও, এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।
এই গাছের রস ব্লাড সুগার লেভেল ও গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ কমায়। একই সাথে এটি গ্লুকোজ-৬ ফসফেট এবং ফ্রুকটোজ ১, ৬ ডাইফসফেট এর কার্যক্ষমতা কমায় ও লিভারের হেক্রোকিনেজ এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এই কালোকেশী গাছকে বলা হয় নিরাপদ কীটনাশক। কারণ এর রস বাড়ির চারপাশে ছিটিয়ে দিলে, পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই মশার লার্ভা ধ্বংস করে।
এছাড়াও এটি কাশি, চুল কালো করাসহ নানা রোগের ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
পাথরকুচি:
পাথরকুচি গাছ চিনে না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। গাছপ্রেমীরা এই গাছের সৌন্দর্যের জন্যই যদিও একে রোপন করে। তবে, বাংলাদেশের সর্বত্রই এর দেখা মেলে। সামান্য একটা পাতা থেকে এই গাছের ঝোপ হতে মাত্র কয়েকদিন লাগে। পাথরকুচির গাছের বৈজ্ঞানিক নাম— Kalanchoe pinnata (Lam.) Pers; যার পরিবার— Crassulaceae। এছাড়াও অন্য প্রজাতির একটি পাথরকুচি আছে, যার পাতা অনেকটা গোল, তার বৈজ্ঞানিক নাম— Berginia ligulata (Wall.) এবং তার পরিবার Saxifragaceae।
![পাথরকুচি](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/480px-Kalanchoe_pinnata_kz1.jpg?resize=282%2C423&ssl=1)
![পাথরকুচি](https://i0.wp.com/techvarce.xyz/wp-content/uploads/2024/02/480px-Kalanchoe_pinnata_kz1.jpg?resize=282%2C423&ssl=1)
পাথরকুচি সাধারণত একটি বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এর পাতার রং সবুজ এবং এই গাছে শীতকালে ফুল ফলের দেখা মেলে। এছাড়াও এর কিছু প্রচলিত নাম হলো: হফপাতা বা কফপাতা (চট্টগ্রাম), পাথান বেইদ, পাটিয়াপুরি, পাষাণবেদ, পাতরপাতা, ইত্যাদি।
পাথরকুচি গাছের রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। এটির পাতা বেঁটে খেলে জ্বর থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এছাড়াও এই পাতার রস পেটের নানা সমস্যা দূর করতে বেশ সহায়ক।
⏩ আরও পড়ুন: টমেটো কি লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে?
এই পাথরকুচি পাতা মূত্রনালির যেকোনো সংক্রমণে, রক্তপিত্ত নিরাময়ে বেশ সহায়ক। এছাড়াও এটি পিষে যেকোনো ক্ষত, চুলকানিতে লাগালে তা তাৎক্ষণিক সেরে যায়। আর, এই পাতার সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো, এর রস খেলে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিশেষ করে— সর্দি-কাশি, গলাব্যথায় এর জুড়ি মেলা ভার। তাইতো একে কফপাতা বলে ডাকা হয়।
**********
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম— জাদুকরী ৫টি ঔষধি গাছ সম্পর্কে। তবে, একটা কথা মাথায় রাখা উচিত, একটি গাছে অনেক ধরনের উপাদান বিদ্যামান থাকে। এইজন্য কোন উপাদানে কার কী সমস্যা থাকে তা বলা যায় না। তাই কোনো কিছু ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যাই হোক, আজকের মতো এখানেই। পরবর্তীতে আরও নতুন নতুন আর্টিকেল পেতে ‘টেকভার্স’ এর সঙ্গে থাকুন।